হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু): এক মহিমান্বিত জীবনী

 


ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাসে যেসব ব্যক্তিত্বের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, তাঁদের মধ্যে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, যিনি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ করেন এমনভাবে, যা আজও প্রশাসন, ন্যায়বিচার ও নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত হিসেবে গণ্য হয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে সম্পর্কে বলেছেন—

“যদি আমার পরে কোনো নবী হতো, তবে উমর হতেন সেই ব্যক্তি।”
(তিরমিজি)

উমর (রা.)-এর জীবনী কেবল ইতিহাস নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্ব, ত্যাগ, ন্যায়বিচার, সাহস ও আল্লাহভীতির শিক্ষণীয় দলিল।


১. নাম, পরিচয় ও বংশ

হযরত উমর (রা.)-এর পূর্ণ নাম — উমর ইবনুল খাত্তাব ইবনু নুফাইল ইবনু আব্দুল উয্জা আল-আদাওয়ী আল-কুরাইশি।
তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের অধিবাসী, যাঁরা মক্কার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভাবশালী ছিল। তাঁর উপাধি ছিল “আল-ফারূক” — অর্থাৎ “সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী”।

জন্ম ও পরিবার

তিনি জন্মগ্রহণ করেন খ্রিষ্টাব্দ ৫৮৪ সালে (প্রায় ১৩ বছর নবীজীর ছোট) মক্কার এক অভিজাত পরিবারে। তাঁর পিতা খাত্তাব ছিলেন কুরাইশ সমাজে কঠোর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। মাতা হনতামা বিনতে হিশাম ছিলেন বেনি মাখজুম গোত্রের নারী।


২. ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী জীবন

ইসলাম গ্রহণের পূর্বে উমর (রা.) ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, সাহসী, কঠোর ও বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি অল্প বয়সেই অক্ষরজ্ঞান অর্জন করেন — যা সে যুগে বিরল ছিল।

সমাজে অবস্থান

তিনি কুরাইশদের প্রতিনিধি হিসেবে যুদ্ধ ও কূটনৈতিক আলোচনায় অংশ নিতেন। শারীরিক শক্তি, যুক্তি ও নেতৃত্বগুণে তিনি ছিলেন অনন্য।
কিন্তু তখনও তিনি ছিলেন মূর্তিপূজার অনুগামী এবং নবীজী ﷺ ও মুসলমানদের অন্যতম শত্রু।

ইসলামবিরোধী অবস্থান

ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে উমর (রা.) মুসলমানদের প্রতি কঠোরতা দেখাতেন। এক সময় তিনি নবীজীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বের হন। কিন্তু সেই যাত্রাতেই তাঁর ভাগ্যের মোড় ঘুরে যায়।


৩. ইসলাম গ্রহণের ঘটনা

ইতিহাসে ইসলাম গ্রহণের তাঁর ঘটনা বিখ্যাত ও আবেগময়।

একদিন তিনি নবীজী ﷺ-কে হত্যা করতে বের হন। পথে নাঈম ইবনু আবদুল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন,
“উমর! কোথায় যাচ্ছ?”
তিনি বললেন, “মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করতে।”
নাঈম বললেন, “তুমি আগে নিজের পরিবারের দিকে তাকাও। তোমার বোন ফাতিমা ও তাঁর স্বামী সাঈদ ইবনু যায়দ ইসলাম গ্রহণ করেছেন।”

এই খবর শুনে উমর ক্রোধান্বিত হয়ে তাঁদের ঘরে প্রবেশ করেন। তখন তাঁরা কুরআনের সূরা ত্বাহা পাঠ করছিলেন।
তিনি তাঁদের প্রহার করেন, রক্তাক্ত করে ফেলেন। কিন্তু পরে যখন তাঁর দৃষ্টি কুরআনের আয়াতের দিকে পড়ে, তিনি থেমে যান।
তিনি পড়েন —

“আমি আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই; সুতরাং তুমি আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণের জন্য সালাত কায়েম কর।”
(সূরা ত্বাহা: ১৪)

এই আয়াত শুনে তাঁর অন্তর কেঁপে ওঠে। তিনি বলেন,
“আমাকে মুহাম্মদের কাছে নিয়ে চলো।”

এরপর তিনি দারুল আরকাম-এ যান, যেখানে নবীজী ﷺ ও সাহাবারা অবস্থান করছিলেন। নবীজী ﷺ তাঁকে দেখে বললেন,

“হে উমর! তুমি এখনো পর্যন্ত সত্য গ্রহণ করোনি?”

তিনি বললেন,
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল।”

মুহাম্মদ ﷺ তাকবির দেন, সাহাবারা আনন্দে চিৎকার করেন— “আল্লাহু আকবার!”

এরপর থেকে তিনি ইসলাম প্রচারের অন্যতম শক্ত স্তম্ভে পরিণত হন।


৪. উমরের ইসলাম গ্রহণে ইসলামী দাওয়াতের প্রভাব

উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামী দাওয়াতের নতুন যুগ শুরু হয়। তাঁর আগে মুসলমানরা গোপনে নামাজ পড়তেন, কিন্তু উমর (রা.) প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করেন।
তিনি নবীজীর কাছে বলেন,

“হে রাসূলুল্লাহ! আমরা কি সত্যের ওপর নই?”
নবীজী বলেন, “হ্যাঁ।”
তিনি বলেন, “তাহলে কেন গোপনে?”

তারপর তিনি মুসলমানদের নিয়ে প্রকাশ্যে কাবা শরিফে নামাজ আদায় করেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রকাশ্য নামাজ।


৫. হিজরতের ঘটনায় তাঁর ভূমিকা

হিজরতের সময় প্রায় সব মুসলমান গোপনে মদিনায় চলে যান। কিন্তু উমর (রা.) খোলা ঘোষণা দিয়েছিলেন।
তিনি তলোয়ার হাতে কাবা ঘুরে বলেন,

“যে তার স্ত্রীকে বিধবা, সন্তানকে পিতৃহারা করতে চায়, সে যেন আমাকে অনুসরণ করে মদিনায় চলে আসে!”

কেউ সাহস করেনি।
এভাবেই তিনি ইসলামী সাহস ও নির্ভীকতার প্রতীক হয়ে ওঠেন।


৬. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে উমর (রা.)

নবীজীর জীবদ্দশায় উমর (রা.) ছিলেন পরামর্শদাতা ও প্রধান সহচরদের একজন। বহু যুদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।

বদর যুদ্ধ

তিনি ছিলেন প্রথম সারির যোদ্ধা। তাঁর পরামর্শে যুদ্ধের অনেক কৌশল গ্রহণ করা হয়।

উহুদ ও খন্দক

সব কঠিন মুহূর্তে তিনি সাহস ও দৃঢ়তা দেখান।

হুদাইবিয়ার চুক্তি

যখন কিছু সাহাবা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, উমর (রা.) তখন নবীজীর প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে শান্তির বার্তা প্রচার করেন।

তাবুক ও বিদায় হজ

নবীজী ﷺ তাঁকে সবসময় পাশে রেখেছিলেন। এমনকি নবীজীর মৃত্যুর পর প্রথম দিকে যখন মুসলমানরা হতবিহ্বল, তখনও উমর (রা.) বলেন,

“যে বলবে মুহাম্মদ মারা গেছেন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেব!”

তখন আবু বকর (রা.) এসে বলেন,

“যে আল্লাহর উপাসনা করত, সে জানুক, আল্লাহ চিরঞ্জীব; আর যে মুহাম্মদকে উপাসনা করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেছেন।”

এ কথা শুনে উমর (রা.) নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।


৭. খলিফা নির্বাচনের প্রেক্ষাপট

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ইন্তেকালের পর প্রথম খলিফা হন আবু বকর (রা.)।
তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি উমর (রা.)-কে উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেন।

আবু বকর (রা.) বলেন:

“উমর আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ ও দৃঢ়চেতা। তাঁর শাসনে ইসলাম নিরাপদ থাকবে।”

মুসলমানরা একমত হয়ে উমর (রা.)-কে দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে বায়আত করে।


৮. উমর (রা.)-এর খিলাফতকালীন প্রশাসনিক ব্যবস্থা

উমর (রা.)-এর শাসনকাল ছিল ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বর্ণযুগ। তিনি এমন এক প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলেন যা ইতিহাসে অনন্য।

প্রশাসনিক সংস্কার

  • ইসলামী রাষ্ট্রকে ৮টি প্রদেশে ভাগ করেন।

  • প্রতিটি প্রদেশে আমির, বিচারক, কর সংগ্রাহক ও সেনাপতি নিয়োগ দেন।

  • কর্মকর্তাদের সম্পদ যাচাইয়ের ব্যবস্থা চালু করেন।

  • রাষ্ট্রীয় কোষাগার (বায়তুলমাল) স্থাপন করেন।

হিসাব-নিকাশ ব্যবস্থা

তিনি প্রথম হিসাব দপ্তর (দেওয়ান) প্রতিষ্ঠা করেন।
এতে সৈনিকদের বেতন, সরকারি খরচ ও সামাজিক ব্যয় লিপিবদ্ধ থাকত।

জনসেবা

তিনি সমাজকল্যাণের জন্য নানা ব্যবস্থা নেন:

  • বিধবা ও এতিমদের জন্য ভাতা

  • অভাবগ্রস্ত পরিবারে রসদ সরবরাহ

  • রাস্তাঘাট ও কূপ নির্মাণ

  • পশুদের জন্যও আলাদা খাদ্য ব্যবস্থা


৯. বিচারব্যবস্থা ও ন্যায়নীতি

উমর (রা.)-এর ন্যায়বিচার ছিল কিংবদন্তি।
তাঁর যুগে “ন্যায়” রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়।

একজন কপট খ্রিষ্টান কপট লোক মিশরীয় গভর্নর আমর ইবনুল আছের ছেলেকে দোষারোপ করলে, উমর (রা.) বলেন,

“হে আমর! মানুষকে কবে থেকে দাস বানালে, অথচ তাঁদের মায়েরা তো স্বাধীনভাবে জন্ম দিয়েছিলেন?”

এই এক বাক্যই বিশ্ব ইতিহাসে ন্যায়ের এক মহত্তম ঘোষণা হয়ে আছে।


১০. অর্থনীতি, বায়তুলমাল ও সমাজ সংস্কার

বায়তুলমাল

উমর (রা.) প্রথমবার রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, যাকাত, খরাজ (ভূমিকর), জিজিয়া ইত্যাদি জমা হত।

সমাজকল্যাণ

তিনি সমাজে ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করেন। কেউ অভুক্ত থাকলে বলতেন,

“যদি ইরাকের কোনো গরীব মানুষ ক্ষুধায় মারা যায়, আমি ভয় করি কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাকে জবাবদিহি করতে বলবেন।”


১১. জিহাদ ও ইসলামী সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ

উমর (রা.)-এর শাসনামলে ইসলামী সাম্রাজ্য অভূতপূর্বভাবে বিস্তৃত হয়।

  • পূর্বে ইরাক ও পারস্য বিজিত হয়।

  • পশ্চিমে সিরিয়া, মিশর ও জেরুজালেম মুসলমানদের অধীনে আসে।

জেরুজালেম বিজয়

যখন জেরুজালেম আত্মসমর্পণ করে, তখন খ্রিষ্টান নেতারা বলেন,
“আমরা কেবল উমরের হাতে আত্মসমর্পণ করব।”
তিনি নিজে উটে চড়ে মদিনা থেকে জেরুজালেমে আসেন, কোনো রাজকীয় আড়ম্বর ছাড়াই।

বিজয়ের পর তিনি বলেন,

“আমরা মানুষকে দাসত্বে রাখার জন্য আসিনি, বরং আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনতে।”


১২. উমর (রা.)-এর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র

উমর (রা.) ছিলেন কঠোর কিন্তু ন্যায়বান, কঠিন কিন্তু কোমল হৃদয়ের মানুষ।
তিনি নিজ হাতে ভিক্ষুকদের খাওয়াতেন, রাতে ছদ্মবেশে মানুষের অবস্থা দেখতেন।

আল্লাহভীতি

তিনি বলতেন,

“আমি চাইতাম, যদি আমি এক পশু হয়ে যেতাম, যাতে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে না হয়।”

আত্মসমালোচনামূলক মনোভাব

তিনি একবার বলেন,

“যদি টাইগ্রিস নদীর তীরে একটি ছাগলও ক্ষুধায় মারা যায়, আমি ভয় করি, আল্লাহ আমাকে প্রশ্ন করবেন কেন ব্যবস্থা নিইনি।”


১৩. উমর (রা.)-এর বিখ্যাত উক্তি ও শাসননীতি

  • “মানুষের ভেতর সে-ই শ্রেষ্ঠ, যার অন্তর বিশুদ্ধ এবং অন্তরে অহংকার নেই।”

  • “যে আল্লাহকে ভয় করে, তার জন্য মানুষ ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

  • “দুনিয়ার সুখে মুগ্ধ হয়ো না, কারণ দুনিয়া এক ভ্রমণশালা মাত্র।”

  • “ন্যায়বিচার না থাকলে কোনো জাতি টিকতে পারে না।”


১৪. শাহাদাত ও মৃত্যু

খ্রিষ্টাব্দ ৬৪৪ সালে (২৩ হিজরি) তিনি ফজরের নামাজে ইমামতি করছিলেন।
একজন পারস্য দাস আবু লুলু ফিরুজ তাঁর ওপর আক্রমণ করে।
তিনি গুরুতর আহত হন, কয়েকদিন পর শাহাদাত বরণ করেন।

মৃত্যুর আগে তিনি বলেন,

“আমার জানাজা যেন নবীজীর পাশে দাফনের অনুমতি নিয়ে হয়।”

আয়িশা (রা.) অনুমতি দেন।
এভাবেই তিনি নবীজী ﷺ ও আবু বকর (রা.)-এর পাশে সমাধিস্থ হন।


১৫. শিক্ষণীয় বিষয়

১️⃣ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাণ।
২️⃣ নেতৃত্ব মানে ক্ষমতা নয়, দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা।
৩️⃣ আল্লাহভীতি ছাড়া প্রশাসন টিকতে পারে না।
৪️⃣ জনসেবাই নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠ গুণ।
৫️⃣ আত্মসমালোচনা ও নম্রতা নেতার গৌরব।
৬️⃣ সমাজে ন্যায্য বণ্টনই শান্তির ভিত্তি।


উপসংহার

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর জীবন কেবল এক সাহাবীর জীবনী নয়, বরং মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
তিনি ন্যায়, শাসন, নেতৃত্ব ও আল্লাহভীতির এমন উদাহরণ রেখে গেছেন, যা আজও মুসলমানদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর।

তিনি ছিলেন খোদাভীরু শাসক, নির্ভীক যোদ্ধা, দরিদ্রের বন্ধু ও ন্যায়ের প্রতীক।

যতদিন ইসলাম থাকবে, ততদিন হযরত উমর (রা.)-এর নাম উচ্চারিত হবে ন্যায়ের আলোয়, আল্লাহভীতির দীপ্তিতে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url