অভিভাবকের দায়িত্ব ও ভূমিকা

 


🕌 অভিভাবকের দায়িত্ব ও ভূমিকা

একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ

ভূমিকা

অভিভাবক—এই শব্দটির ভেতরে আছে এক বিশাল দায়িত্ব, গভীর ভালোবাসা ও মানবিক সম্পর্কের গভীরতা। একজন অভিভাবক শুধু সন্তান জন্ম দেন না, বরং তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। ইসলামের দৃষ্টিতে অভিভাবকত্ব একটি আমানত, একটি জবাবদিহিতার দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সন্তান দান করেছেন একটি পরীক্ষা ও দায়িত্ব হিসেবে, যেন সে সন্তানকে সঠিক পথে লালনপালন করে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে গড়ে তোলে।

বর্তমান সমাজে অভিভাবকের ভূমিকা শুধু পরিবারের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজ গঠন, জাতি গঠন এবং মানবিক মূল্যবোধ রক্ষায়ও অভিভাবকদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, প্রযুক্তির আসক্তি এবং ধর্মীয় জ্ঞানের ঘাটতির কারণে অনেক অভিভাবক তাদের প্রকৃত দায়িত্ব ভুলে যাচ্ছেন। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব অভিভাবকের দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে—ইসলামিক দৃষ্টিতে, সামাজিক দৃষ্টিতে, নৈতিক ও শিক্ষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে।


অধ্যায় ১: অভিভাবকত্বের অর্থ ও গুরুত্ব

“অভিভাবক” শব্দের অর্থ হলো—যিনি দায়িত্ব নেন, যত্ন করেন, রক্ষা করেন, এবং সঠিক পথে পরিচালনা করেন। ইসলামী পরিভাষায় অভিভাবকত্ব (Wilayah) বলতে বোঝানো হয়—যে ব্যক্তি অন্য কারো (বিশেষত সন্তান বা পরিবারের) হেফাজত, পরিচালনা ও দিকনির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন।

কুরআনে অভিভাবকের দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।”
— (সূরা আত-তাহরীম, আয়াত ৬)

এই আয়াত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়—অভিভাবকের প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তান ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ, তাদের ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলা, ঈমান-আখলাকের শিক্ষা দেওয়া, এবং হারাম থেকে বিরত রাখা।

ইসলাম অভিভাবকত্বকে আমানত হিসেবে ঘোষণা করেছে

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রাখাল, এবং প্রত্যেকেই নিজের অধীনস্থদের জন্য জবাবদিহি করবে।”
— (সহীহ বুখারী, মুসলিম)

অর্থাৎ, একজন বাবা-মা হলো সন্তানের রাখাল। সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা মানে একটি মহান আমানতের প্রতি খেয়ানত করা।


অধ্যায় ২: অভিভাবকের মূল দায়িত্বসমূহ

১. সন্তানকে ঈমান ও আকীদার শিক্ষা দেওয়া

অভিভাবকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো সন্তানকে ইসলামী আকীদা ও ঈমানের ভিত্তিতে গড়ে তোলা। আল্লাহর একত্ব, নবুয়ত, পরকাল, কুরআনের শিক্ষা—এই মৌলিক বিষয়গুলো শিশুর মনে ছোটবেলা থেকেই প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন।

লুকমান (আ.) তার সন্তানকে উপদেশ দিয়েছিলেন—

“হে আমার ছেলে! আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরীক করো না; নিশ্চয়ই শিরক একটি মহা অন্যায়।”
— (সূরা লুকমান: ১৩)

এই আয়াত অভিভাবকদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা—সন্তানের প্রথম পাঠ হতে হবে ঈমান ও তাওহীদের শিক্ষা।


২. নামাজ ও ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা

নামাজ ইসলামের স্তম্ভ। অভিভাবকের কর্তব্য সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই নামাজের অভ্যাসে অভ্যস্ত করা।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও, আর দশ বছর বয়সে নামাজ না পড়লে হালকা শাস্তি দাও।”
— (আবু দাউদ)

অভিভাবক যদি নিজে নামাজে অনিয়মিত হন, সন্তান তার অনুসরণ করবে না। তাই অভিভাবককে নিজেও ইবাদতে দৃঢ় হতে হবে।


৩. নৈতিকতা ও চরিত্র গঠন

একজন সুশিক্ষিত সন্তানই নয়, একজন সচ্চরিত্রবান সন্তানই সমাজের সম্পদ। অভিভাবককে শুধু স্কুলে পাঠানোই নয়, বরং সন্তানের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা, সততা, পরিশ্রম, নম্রতা, এবং অন্যের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে তুলতে হবে।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সম্মান করো এবং তাদের চরিত্র সুন্দর করো।”
— (ইবনে মাজাহ)


৪. দুনিয়াবি ও আখিরাতি শিক্ষায় সমন্বয় করা

শুধু দুনিয়ার শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, আবার শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দিলেও সন্তান বাস্তব জীবনে টিকে থাকতে পারবে না। ইসলামের শিক্ষা হলো—উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।
অভিভাবককে এমনভাবে দিকনির্দেশনা দিতে হবে যেন সন্তান দুনিয়াতেও সফল হয়, আবার আখিরাতেও মুক্তি লাভ করে।


৫. সন্তানের মানসিক বিকাশে ভূমিকা

প্রতিটি শিশুর ভেতর আলাদা প্রতিভা থাকে। অভিভাবককে সন্তানের মানসিক অবস্থা, আগ্রহ ও স্বপ্ন বুঝে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। অযথা তুলনা, তিরস্কার বা অবহেলা তার আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়।

সন্তান যেন নিজের অভিভাবককে তার “বন্ধু” হিসেবে দেখতে পারে—এমন সম্পর্ক গড়ে তোলাই আজকের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


অধ্যায় ৩: ইসলামে পিতা ও মাতার পৃথক ভূমিকা

পিতার ভূমিকা

  • পরিবারের অভিভাবক ও নেতা।

  • সন্তানের খরচ ও দায়িত্বের প্রধান দায়িত্বশীল।

  • সন্তানের শিক্ষা, নামাজ, নৈতিকতা, বন্ধু-বান্ধব—সবকিছুর ওপর নজর রাখা।

  • সন্তানের প্রতি সময় দেওয়া, দিকনির্দেশনা দেওয়া, এবং আদর্শ রোল মডেল হওয়া।

মাতার ভূমিকা

  • সন্তানের প্রথম শিক্ষক।

  • সন্তানের আবেগ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু।

  • ঘরে ইসলামি পরিবেশ সৃষ্টি করা।

  • সন্তানকে কুরআন শিক্ষা ও আখলাকে পরিপূর্ণ করতে অবদান রাখা।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“জান্নাত তোমার মায়ের পায়ের নিচে।”
— (নাসায়ী)

এই হাদীস শুধু মাতার মর্যাদা নয়, বরং তার দায়িত্বের গুরুত্বও নির্দেশ করে।


অধ্যায় ৪: অভিভাবকের ভুল ও অবহেলা

আজকের সমাজে দেখা যায়, অনেক অভিভাবক সন্তানকে মোবাইল, টেলিভিশন, গেমস, সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছেন। তারা মনে করেন সন্তানের জন্য শুধু ভালো স্কুলে পড়ানোই যথেষ্ট। অথচ সন্তান নৈতিকতা হারাচ্ছে, ঈমান দুর্বল হচ্ছে, এবং সমাজবিরোধী প্রভাবের শিকার হচ্ছে।

অভিভাবকদের কিছু সাধারণ ভুল—

  1. সন্তানকে সময় না দেওয়া

  2. ধর্মীয় শিক্ষা অবহেলা করা

  3. অন্যের সন্তানের সাথে তুলনা করা

  4. অতিরিক্ত আদর বা কঠোরতা

  5. সামাজিক চাপের কারণে অন্ধ অনুকরণ

  6. প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারে ছাড় দেওয়া

এই সব ভুলের কারণে সন্তান বিপথগামী হতে পারে, যা সমাজে এক বিশাল প্রভাব ফেলে।


অধ্যায় ৫: আধুনিক সমাজে অভিভাবকের চ্যালেঞ্জ

  • ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব: অনলাইনে অশালীনতা, সময় নষ্ট, মিথ্যা আদর্শ—এসব থেকে সন্তানকে রক্ষা করা এখন বড় দায়িত্ব।

  • পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ: পোশাক, আচরণ, চিন্তাধারায় ইসলামবিরোধী ধারা ঢুকে যাচ্ছে।

  • অর্থনৈতিক চাপ ও সময় সংকট: বাবা-মা দুজনই চাকরিতে ব্যস্ত, ফলে সন্তান একাকিত্বে ভুগছে।

  • মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা: শিশুদের উদ্বেগ, হতাশা, আত্মবিশ্বাসহীনতা বাড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে অভিভাবককে সচেতন, শিক্ষিত ও ধর্মীয় দিক থেকে দৃঢ় হতে হবে।


অধ্যায় ৬: একজন আদর্শ অভিভাবকের গুণাবলি

১. ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন
২. সন্তানদের প্রতি সহানুভূতিশীল
৩. সময় দেন ও শুনতে জানেন
৪. নিজের চরিত্রে আদর্শ স্থাপন করেন
৫. সন্তানকে ভালো বন্ধু নির্বাচন শেখান
৬. মসজিদ, মাদরাসা, ও ইসলামিক পরিবেশে সন্তানকে যুক্ত রাখেন
৭. দোয়া করেন এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“তোমার সন্তানের জন্য তোমার দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যাত হয় না।”
— (তিরমিযি)


অধ্যায় ৭: অভিভাবকত্ব ও সমাজ গঠন

একজন সৎ অভিভাবক শুধু নিজের সন্তানকেই নয়, সমাজকেও উপহার দেন একজন সৎ নাগরিক। একজন নৈতিক ও আল্লাহভীরু সন্তান সমাজে ন্যায়ের প্রতীক, অন্যদিকে দায়িত্বহীন অভিভাবক সমাজে অপরাধ, অন্যায় ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

সন্তানই জাতির ভবিষ্যৎ, আর অভিভাবক সেই ভবিষ্যতের নির্মাতা।


অধ্যায় ৮: উপসংহার

অভিভাবকত্ব কোনো সহজ দায়িত্ব নয়; এটি একটি ইবাদত, একটি আমানত, একটি পরীক্ষা।
একজন অভিভাবকের আচরণ, আদর্শ, দোয়া ও ত্যাগের মাধ্যমেই একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
যে অভিভাবক সন্তানকে ঈমান, আখলাক ও জ্ঞান দিয়ে গড়ে তোলেন, তিনি শুধু পরিবার নয়—সমগ্র সমাজ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখেন।

আজ আমাদের প্রত্যেক অভিভাবককে আত্মসমালোচনা করতে হবে—
আমরা কি আমাদের সন্তানকে কেবল দুনিয়ার সফলতা দিচ্ছি, নাকি আখিরাতের মুক্তির পথও দেখাচ্ছি?

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে এমন অভিভাবক বানান, যারা নিজেদের পরিবারকে ঈমান, নৈতিকতা ও ইসলামী আদর্শে গড়ে তুলতে পারে।
আমীন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url